শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪   চৈত্র ১৫ ১৪৩০

ধর্ষণের প্রতিযোগিতা

প্রকাশিত: ৩ আগস্ট ২০১৭   আপডেট: ৩ আগস্ট ২০১৭

যুগেরচিন্তা২৪.কম: ধর্ষণ। নারীর দেহ ও মনের ওপর এক চরম নির্মমতা। দিন দিন বাড়ছে ধর্ষণ নামের নির্মমতা। এ যেন এক প্রতিযোগিতা কে কত ধর্ষণ করতে পারে। এই বর্বরতার শিকার শুধু নারীই নয়, শিশু-কিশোরও হচ্ছে । ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণই শেষ নয়, খুন করা হচ্ছে নৃশংসভাবে। গত কয়েক মাস ধরে যেন ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর খুনের উৎসব চলছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানও দিচ্ছে অভিন্ন তথ্য। একাধিক সংস্থার হিসাবে গত ছয় বছরের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে যতটি করে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে গত ৬ মাসেই তা ছাড়িয়ে গেছে। সে হিসেবে এ ভয়াবহ অপরাধ এখন দ্বিগুণহারে বাড়ছে। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাইকোথেরাপি বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মোহিত কামাল মানবজমিনকে বলেন, সংস্থাগুলোর পরিসংখ্যানের মতো আমাদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণেও ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। নারী-পুরুষের যৌন সঙ্গমের ছবি ও ভিডিও পর্নোস্টারদের নিখুঁত অভিনয়ে তৈরি ঝকঝকে পর্নোগ্রাফিগুলো হাতে হাতে পৌঁছে যাচ্ছে। তা দেখে প্রাপ্ত ও অপ্রাপ্ত বয়স্করা নিজেদের যৌন প্রবৃত্তিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। বেপরোয়াভাবে ভোগবাদী হয়ে উঠছে। ফলে নারীকে ভালোবাসা, বিয়ে ইত্যাদির মাধ্যমে জয় করে স্বাভাবিক যৌন সম্পর্ক স্থাপনের পরিবর্তে অরক্ষিত নারী ও শিশুদের জোরপূর্বক ধর্ষণ করে বসছে। অনেক কারণের মধ্যে এটি এখন নারী ও শিশু ধর্ষণ বাড়ার প্রধান কারণ বলেও জানান তিনি। গত রোববার রাজধানীর বাড্ডায় মাত্র ৩ বছর ৯ মাস বয়সী শিশু তানহাকে ধর্ষণের পর খুন করেছে শিপন নামে এক পাষণ্ড। গত ১৭ই জুলাই বগুড়ায় এক ছাত্রীকে কলেজে ভর্তির নামে ধর্ষণ করে তুফান সরকার। এরপর বিচার চাইলে ন্যক্কারজনকভাবে মা-মেয়ের মাথা ন্যাড়া করে দেয়া হয়। গত বুধবার রাজশাহীতে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে গণধর্ষণ করা হয়েছে। গত বুধবার নারায়ণগঞ্জে চলন্ত ট্রাকে এক কিশোরীকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেছে গাড়ি চালক ও হেলপার। এভাবে প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নারী। বাদ যাচ্ছে না ১৮ বছরের কম বয়সী কন্যা শিশুও। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে তিন বা চার বছরের দুধের শিশুও শিকার হচ্ছে এই বিকৃত যৌনতার। এতেই থামছে না ধর্ষক। ধর্ষণের পর ধর্ষিতাকে খুনও করা হচ্ছে। কিন্তু সমাজে ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর লোকলজ্জায় এসব ঘটনার সিংহভাগই প্রকাশ করছে না ভিকটিম। সামাজিক অসম্মানের ভয়ে তা লুকিয়ে যাচ্ছে তাদের পরিবার। দীর্ঘ মেয়াদে হেনস্থার ভয়ে করছে না মামলা। বরং জানাজানি হওয়ার ভয়ে নারীর উপর এসব ঘটনায় ভিকটিম ও পরিবার এমনভাবে চেপে যাচ্ছে যেন কিছুই ঘটেনি। তারপরও ছিটেফোঁটা যে ক’টি ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে তাতেই এখন আঁতকে উঠার মতো পরিস্থিতি। এতেই সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে চলতি বছর দ্বিগুণহারে বাড়ছে ধর্ষণের ঘটনা। এই চিত্র যেমন রাজধানী শহর ঢাকায়। তেমনি সারা দেশের। এর মধ্যে কিছু কিছু ধর্ষণের নির্মমতা হতবাক করে দিচ্ছে সবাইকে। রাজধানীর ৪৯ থানায় ঘটা নারী ও শিশু ধর্ষণসহ তাদের উপর সংঘটিত ঘটনার স্পর্শকাতর মামলাগুলো তদন্তের দায়িত্ব পড়ে তেজগাঁওয়ের ওম্যান সাপোর্ট ও ইনভেস্টিগেশন সেন্টারের উপর। চলতি বছরের অর্ধেকে এরই মধ্যে সেখানে সাম্প্রতিক অন্য বছরগুলোর প্রায় সমানসংখ্যক মামলা তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছে। ২০১৭ সালের ১৩ই জুলাই পর্যন্ত সেখানে স্পর্শকাতর ৫১টি ধর্ষণের মামলা পাঠানো হয়। এছাড়া ১৫টি শ্লীলতাহানি, ৫৫টি অপহরণ ও ১০২টি যৌতুক ও বাকি ২টি অন্যান্য মামলা স্থানান্তর হয়েছে। তার আগের বছর ১২৭টি ধর্ষণের মামলা সেখানে তদন্তের জন্য পাঠানো হয়েছিল। তার আগে ২০১২ সালে ৭১, ২০১৩ সালে ৭৬, ২০১৪ সালে ৮৫ ও ২০১৫ সালে ৬৬ মামলা সেখানে স্থানান্তর হয়। ওই ৬ বছরের মধ্যে রাজধানীতে ক্রমেই (২০১৫ সাল ছাড়া) নারী ও শিশু ধর্ষণের স্পর্শকাতর মামলা বেড়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের ওম্যান সাপোর্ট ও ইনভেস্টিগেশন বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, এখানে নারী ও শিশু ধর্ষণসহ তাদের উপর নির্মমতার স্পর্শকাতর মামলাগুলো তদন্তের জন্য আসে। অতীতের চেয়ে এখন সে ধরনের মামলা বেশি আসছে। নারী এবং শিশু ধর্ষণও বেড়েছে। বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) হিসাবে দেখা গেছে ২০১২ সাল থেকে নারী ধর্ষণের হার ক্রমেই (২০১৪ ছাড়া) বাড়ছে। ২০১২ সালে ৮০ নারী ধর্ষণ, ৩০ জন ধর্ষণের পর খুন ও ২৬ নারী গণধর্ষণের শিকার হন। ২০১৩ সালে ১০৭ নারী ধর্ষণ, ১৬ নারী ধর্ষণের পর খুন এবং ৩৫ নারী গণধর্ষণের কবলে পড়েন। ২০১৪ সালে ১৫৩ নারী ধর্ষিতা, ৪৮ জন খুন ও ৮৬ জন গণধর্ষণের শিকার হন। ২০১৫ সালে ১৩৪ ধর্ষণ, ৪৮ জন ধর্ষণের পর হত্যা ও ১০৩ জন নারী গণধর্ষণের কবলে পড়েন। ২০১৬ সালে ১৪১ নারী ধর্ষিতা এবং ৩৩ জন ধর্ষণ শেষে খুন ও ৭৭ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। চলতি বছর গত জুন পর্যন্ত প্রথম ৬ মাসে এরই মধ্যে ১৪১ জন নারী ধর্ষণ ও ৪৩ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর প্রাণ দিতে হয়েছে ১৪ হতভাগীকে। তাছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শিশু ধর্ষণ, গণধর্ষণ এবং হত্যার সংখ্যাও কম নয়। ২০১৪ সালে ১১৫, ২০১৫ সালে ১৪১, ২০১৬ সালে ১৫৮ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। আর এ বছর গত জুন পর্যন্ত এরই মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৪৪ শিশু। গত বছর মোট ২৯৯ নারী ও শিশু (এককভাবে) ধর্ষণের শিকার হলেও এ বছর ৬ মাসে এ সংখ্যা ২৮৫তে দাঁড়িয়েছে। শুধু তাই নয়। সংস্থাটির গত মাসের প্রতিবেদনটি রীতিমতো ভয়াবহতার আভাস দিচ্ছে। সে প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত জুলাইয়ে ৮০ নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ৩২ জনই শিশু। আর ৩ শিশুই ধর্ষণের পর খুনের শিকার হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার (বিএমবিএস) চেয়ারম্যান সিগমা হুদা বলেন, দেশে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি বিরাজ করছে। একই সঙ্গে পর্নোগ্রাফী হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে। এসব কারণে নারী ও শিশুরা যখন তখন ধর্ষণ, গণধর্ষণ ও খুনের শিকার হচ্ছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এ বছর প্রথম ৬ মাসেই তা প্রায় দ্বিগুণে দাঁড়িয়েছে। এটাকে তো মহামারী বলতেই হয়। এখনই নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে তা আগামী বছরগুলো তা আরো বাড়বে। মানবজমিন
এই বিভাগের আরো খবর