শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পানিবন্দি ২০ লাখ অধিবাসী : শিমরাইল পাম্প হাউজের বিকল পাম্পেই ডিএনডিতে কৃত্রিম বন্যা

প্রকাশিত: ১৮ জুন ২০১৭   আপডেট: ১৮ জুন ২০১৭

ষ্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪ ডটকম) : নারায়ণগঞ্জে ডিএনডি অধ্যুষিত এলাকা ফতুল্লা ও সিদ্ধিরগঞ্জে পানিবন্দি হয়ে চরম দূর্ভোগে রয়েছেন ২০ লাখ অধিবাসী। নদীর সাথে বাঁধ এলাকায় স্বাভাবিক পানির লেভেল ২ দশমিক ৭ মিটার থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে তা বেড়ে ৩ দশমিক ৩ মিটারে উন্নীত হয়েছে। বর্ষার বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ পানি নিস্কাশনের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পানি বৃদ্ধির অন্যতম কারন হিসেবে চিহ্নিত। অন্যদিকে শিমরাইল পাম্প হাউজের অধিকাংশ পানি নিষ্কাশনের পাম্প বিকল হয়ে পড়ে আছে। পাম্পগুলো বিকল থাকায় চাহিদানুসারে পানি নিষ্কাশন না হওয়াই ডিএনডি অধ্যুষিত এলাকার জলাবদ্ধতার প্রধান কারন হয়ে দাড়িয়েছে। যার ফলে ডিএনডিবাসীকে চরম দূর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। অপর দিকে, ডিএনডির জলাবদ্ধতা স্থায়ীভাবে নিরসন ও পানি নিষ্কাশনে একনেকের সভায়  প্রায় ৫৫৮ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প পাস হলেও বাস্তবে এর প্রতিফলন মেলেনি। অভিযোগ রয়েছে, আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে ধীর গতিতে। এদিকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্তির জন্য ডিএনডিবাসী মানববন্ধন, বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আন্দোলন করলেও পাম্প হাউজ কর্তৃপক্ষ পাম্প মেরামতের নামে বছরের পর বছর বিল ভাউচার তৈরী করে সরকারি লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সরেজমিনে ডিএনডি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ডিএনডির পানি নিষ্কাশনের জন্য পাগলার নয়ামাটি থেকে একটি খাল ফতুল্লা শিবু মার্কেট হয়ে সিদ্ধিরগঞ্জ পাম্প হাউজে গিয়ে মিশেছে। খালের বেশির ভাগ অংশই দখল ও ভরাট হয়ে গেছে। বিশেষ করে শিবু মার্কেট বাজার ও শিমরাইল পাম্প হাউজ সংলগ্ন ৪/৫টি মার্কেটের পয়ঃনিস্কাশন বর্জ্য ও পলিথিন ফেলে পুরো খালটি ঢেকে ফেলা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের পেছন থেকে শিবু মার্কেটের লিংক রোড ব্রিজ পর্যন্ত খাল দিয়ে পানির প্রবাহ প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইলস্থ ডিএনডি’র (ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা) পানি নিস্কাশন পাম্প হাউজে গিয়ে দেখা যায়, ৪টি শক্তিশালী পাম্পের মধ্যে ৩টি সচল এবং ১টি যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও ২২টি সহযোগী পাম্পের মধ্যে ৫টি সচল এবং ১৭টি যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে বিকল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি পাম্প অনেকদিন ধরে না চালানোর কারনে পাইপে মরিচা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ডিএনডি অভ্যন্তরে বৃষ্টির কারনে যে পরিমান পানি আটক হয়েছে সে পানি দ্রুত নিস্কাশনে প্রয়োজনীয় পাম্প সচল না থাকায় প্রতিদিনের বৃষ্টিতে জলাবদ্ধ হয়ে কৃত্রিম বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে নারায়ণগঞ্জের প্রায় ২০ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে অবর্ননীয় দূর্ভোগে রয়েছে। এমনকি পানিবন্ধী মানুষ ময়লাযুক্ত ডাইংয়ের কালো পানিতে পানিবাহী রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। অপরদিকে ডিএনডির প্রধান পানি নিস্কাশন খালের পাম্প হাউজ মুখে ময়লা আবর্জনা ও পলিথিন  জমাট হওয়ার কারণেও পাম্প হাউজে পানি নিস্কাশনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। যে কারনে পাম্প হাউজ মুখে স্বাভাবিকভাবে পানি আসতে পারছেনা। পাম্প হাউজ কর্তৃপক্ষ প্রায়ই পাম্প হাউজ মুখ থেকে ময়লা আবর্জনা সড়ালেও খালের পশ্চিম দিকে কয়েক কিলোমিটার ময়লা আবর্জনা পলিথিন ও কচুরীপানায় ডেকে আছে খালটি। এই খাল দখল ও ভরাট করে মার্কেট মালিকসহ একটি প্রভাবশালী মহল অস্থায়ী দোকানপাট তৈরি করে পজিশন বিক্রি ও ভাড়া দিয়ে কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লি¬ষ্ট তদারককারীদের আর্থিকভাবে ম্যানেজ করেই এই খাল দখল ও ভরাট করে দোকানপাট তৈরি করা হয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছেন। সূত্রমতে, ৩২ দশমিক ৮ বর্গ কিলোমিটার ঘেরা এই ডিএনডি প্রজেক্টের অভ্যন্তরের পানি নিস্কাশনের জন্য ৯০ কিলোমিটার প্রধান নিস্কাশন খাল রয়েছে। ময়লা আবর্জনা কচুরীপানা ও পলিথিন ও খাল ভরাটের কারণে এ খালের অধিকাংশ স্থানেই প্রতিবন্ধকতার কারণে পানি চলাচল করতে পারছেনা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতা ও তদারকী না থাকায় পানি নিস্কাশন খাল আজ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। খালে পানির প্রবাহ গতি না থাকায় মাত্র কয়েক ঘন্টার বৃষ্টিতেই ডিএনডির সিংহভাগ এলাকা পানিতে ডুবে যায়। পানি নামতে না পারার কারণে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। ডিএনডির প্রধান পানি নিস্কাশন খাল ও শাখা খাল গুলো পরিস্কার ও খনন না করা এবং অধিকাংশ পাম্প বিকল থাকায় আবারো ডিএনডির ২০ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্ধী হয়ে পড়েছে। পানি চলাচলের খাল খনন ও অবৈধ দখলদারমুক্ত না করার কারণে প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে ডিএনডিবাসী পানিবন্দী হয়ে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহায়। গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে এখনো ডিএনডির নিম্নাঞ্চলের অনেক রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে আছে। পানি সরতে না পারার কারণে সৃষ্টি হয়েছে কৃত্রিম বন্যা। সিদ্ধিরগঞ্জ থানা স্বেচ্ছাসেবকলীগের সাধারন সম্পাদক আমিনুল হক রাজু বলেন, প্রতি বছরই পাম্প মেরামতের জন্য পাম্প হাউজ কর্র্র্তৃপক্ষ মেরামতের খরচ বাবদ বিল ভাউচার তৈরী করে কোন প্রকার কাজ না করেই সরকারী লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। আর ভোগান্তিতে আছি আমরা। নাসিক ৭নং ওয়ার্ডের কদমতলী এলাকার বাসিন্ধা প্রবীন সাংবাদিক ও কলামিষ্ট এম এ মাসউদ বাদল বলেন, ডিএনডিতে পরিকল্পিতভাবে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জে দুই কর্ণধার শামীম আইভীর রোষানলে কৃত্রিম বন্যার এ দূভোগ পোহাতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। শিমরাইল পাম্প হাউজের উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাম প্রসাদ বাছার বলেন, পানি নিস্কাসনের ৪টি পাম্পের মধ্যে ৩টি সচল এবং ১টি যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে বন্ধ রয়েছে। এছাড়াও ২২টি সহযোগী পাম্পের মধ্যে ৫টি সচল এবং ১৭টি যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে বিকল রয়েছে। ১৫ দিন ধরে বিকল পাম্পগুলো মেরামতের কাজ চলছে। বৈরী আবহাওয়ার কারনে আমাদের কাজ করতে একটু সময় লাগছে। এছাড়া পাম্প হাউজের ৫১২ কিউসেক ক্ষমতা সম্পন্ন চারটি পাম্পই ৫০ বছরের পুরনো। এগুলোর কর্মক্ষমতাও আগের মতো  নেই । প্রকল্প অনুমোদনের পর বছর পার হলেও কাজ না হওয়ার বিষয়ে ডিএনডির পানি নিষ্কাশন প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. আব্দুল আউয়াল মিয়া বলেন, দ্রুত গতিতে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে চলছে। কাজের ডিজাইন প্রায় শেষ, চলতি বর্ষা মৌসুম শেষ হলেই আগামী নভেম্বর মাসে মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু হবে। সেনাবাহিনী কাজটি বাস্তবায়ন করবে। ডিজাইন সম্পন্ন হলেই সেনাবাহিনী রেট কোড দেবে। প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে জেলা প্রশাসকের কাছেও প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। এছাড়া সয়েল টেস্টসহ বিভিন্ন কাজ চলছে দ্রুতগতিতে। উল্লেখ্য, ১৯৬৫-১৯৬৮ সালে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা অঞ্চলের ৬ হাজার হেক্টর জমি নিয়ে ইরিগেশনের জন্য গড়ে তোলা হয় ডিএনডি প্রজেক্ট। একের পর এক এখানে গড়ে উঠতে শুরু করে শিল্প-কারখানা ও বাড়িঘর। বর্তমানে প্রজেক্টটি আবাসিক ও শিল্পাঞ্চলে পরিণত হয়েছে। প্রায় ২০ লাখ মানুষ এখানে বসবাস করছেন।
এই বিভাগের আরো খবর