বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

অর্থ ও ক্ষমতার দাম্ভিকে বিচার পেলনা সজলা, পোড়া ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছেন

প্রকাশিত: ১৭ জুন ২০১৭   আপডেট: ১৭ জুন ২০১৭

স্টাফ রিপোর্টার (যুগের চিন্তা ২৪ ডটকম) :  ক্ষমতার কাছে পরাজিত একজন সজলা শীল। ঘটনার এতোদিনে এসে বিচার পাওয়াতো দূরের কথা বেঁচে থাকাই এখন দায়। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক সংগঠন ও উর্দ্ধতন প্রশাসনের  চাপে পুলিশ বাধ্য হয়ে ঘাতক শাহ আলমকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। থানায় উপস্থিত সজলা শাহ আলম কে নির্দোষ ও নিজের অসতর্কতার কারনেই এমনটা ঘটেছে এই মর্মে লিখিত দেয়। অভিযোগ আছে টাকা ও ক্ষমতার প্রভাবে সেদিনই থানা থেকে ফিরে আসে ঘাতক শাহ আলম। সজলা ভাতের হাড়ি ঘরে নিয়ে যাওয়ার সময় পা পিছলে তার হাতের ভাত তারই পিঠে পরে! অভিযুক্ত বাড়ি ওয়ালা শাহ আলম ঘটনার সঙ্গে জড়িত না! তবুও তিনি প্রায় অর্ধ লক্ষ টাকার চিকিৎসা করিয়েছেন সজলা শীল কে! ভবিষ্যতেও যত টাকা লাগে তিনিই দেবেন! এমন গল্প তৈরী করা হয়েছে ঘটনার ধামা চাঁপা দেয়ার জন্য। যারা গল্প বলেছেন তাঁদের যখন প্রশ্ন করা হয়েছে গরম ভাত হাত কেমন করে পিঠের উপরে পরে? শুকনো ভাত কেমন করে শাড়ী ব্লাউজ ভেদ করে পিঠের সম্পূর্ণ অংশ পুড়িয়ে দিতে পারে? আর ঘটনার সাথে সম্পৃক্ততা না থাকা সত্বেও শাহ আলমই বা কেন সম্পূর্ণ খরচ বহন করছে? জবাবে কেউ তেমন সদোত্তর দিতে পারেননি। সরেজমিনে পাওয়া তথ্য মতে, সজলা সেদিন তার বাড়িতে বসে ভাত রান্না করছিলেন। শাহ আলমের ৫ বছর বয়সী ছেলে সজলাদের বাড়ির গেট ধরে দাড়িয়ে ছিল। সজলার ১৫ বছর বয়সী মেয়ে গেট খুলতে গেলে ছোট্ট ছেলেটির হাত বাড়ির গেইটে চাপা পরে। ছেলের চিৎকার শুনে ছুটে আসেন শাহ আলম। এ নিয়ে তর্ক হয় সজলার সঙ্গে শাহ আলমের। একেতো গরীব, তার মধ্যে স্বামী-শ^শুর পেশায় নাপিত। এমন ঘরের বউ হয়ে নিজ সন্তানের পক্ষ নেয়াটাই ছিল সজলার মস্ত ভুল। সেই ক্ষমার অযোগ্য ভুলের মাশুল ও গুনছেন সজলা ও তার পরিবার। পিঠের পোড়া ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় কাৎরাচ্ছেন সজলা। আর  স্বামী তপন শীল কখনো হুমকীর স্বীকার হচ্ছেন স্থানীয় প্রভাবশালী মহলের। কখনো সহ্য করছেন প্রভাশালীর বেত্রাঘাত। এ নিয়ে কোন কথা বলতে মানা। তার চেয়ে শাহ আলমের সঙ্গে আপোষ করার মাধ্যমে চিকিৎসা খরচ নেয়াটাকেই নিজের জন্য মঙ্গলজনক বলে বুঝানো হয়েছে তপনকে । নিজ সন্তানের পক্ষ নিয়ে তর্কের এক পর্যায়ে সজলার গায়ে শাহ আলম লাত্থি মারলে জলন্ত চুলার উপড়ে ছিটকে পরে সজলা । আর সজলার পিঠে পরে চুলায় থাকা ফুটন্ত ভাতের মাড়! অঠালো মাড় সাথে সাথেই তার শাড়ী ও ব্লাউজ ভেদ করে পিঠে লেগে যায়।  সজলার গগনবিধারী চিৎকারে প্রকম্পিত হয় উলুকান্দির আকাশ। সেদিন আর পুড়ে যাওয়া শরীরের চিকিৎসা হয়নি। পোড়া শরীর নিয়ে সারা রাত যন্ত্রনায় চিৎকার করেছেন সজলা। এরই মধ্যে ঘটনা ধামা চাপা দিতে তৎপর হয়ে উঠে ঘাতক শাহ আলম। এলাকার প্রভাবশালীদের আশ্রয় নেয়। সে আশ্রয়ে কাজ হয়। ঘটনার ২০ দিন পরও এ ব্যাপারে থানায় অভিযোগ পর্যন্ত দায়ের করার সাহস হয়নি সজলার পরিবারের । বরং থানায় গিয়ে সজলাকে বলে আসতে হয়েছে “কারো বিরুদ্ধে আমার কোন অভিযোগ নেই। আমার ভুলেই এমনটা হয়েছে।” আড়াই হাজার থানার গোপালদী পৌরসভার উলুকান্দি গ্রাম। সে গ্রামের ঝালো পাড়া এলাকার বাসিন্দা তপন শীল। দুই সন্তান, স্ত্রী সজলা শীল ও বৃদ্ধ বাবা রঞ্জিৎ চন্দ্র শীলকে নিয়ে তার পরিবার। বৃদ্ধ বাবা ও তিনি নাপিতের কাজ করে সংসার চালান। ভাড়া থাকেন ইসমাইল মেম্বারের বাড়িতে।সে বাড়ির আগের মালিক ছিল মৃত শাহ জালাল মেম্বার। নিজের পিতৃভিটা বিক্রী করে পাশেই আরেক বাড়িতে থাকেন শাহ জালালের ছেলে শাহ আলম। বিদেশ ফেরত শাহ আলমের এক সন্তান। সাড়ে তিন বছর পূর্বে দেড় বছর বয়সী সন্তানকে রেখে শাহ আলমের ঘর ছেড়ে চলে যায় তার স্ত্রী। বাড়ির পাশেই একটি মুদি দোকান চালান শাহ আলম। এতো মর্মান্তিক একটি ঘটনা সম্পর্কে আশপাশের মানুষগুলোর স্পষ্ট ধারনা নেই। কারন প্রথম দিন থেকেই তপন শীল ও তার বাবাকে হুমকী দেয়া হয়েছে ঘটনার জানাজানি হতে দেয়া যাবেনা। যারাই বা শুনেছেন লোকমুখে তাদেরও ভীড়তে দেয়া হয়নি সজলাদের বাড়ির দিকে। যারাইবা কিছুটা জানেন তারাও মুখ খুলতে রাজি না। সহজ কথা ‘ মাফ কর বাবা আমি কিছুই জানিনা’।  অথচ কিছুক্ষণ লেগে থাকার পর তারাই কিছুটা মুখ খুলেছেন। বলেছেন সজলার দুর্দশার কথা। আর সজলার স্বামী তপন শীল বলেছেন ঘটনার দিন তার ৩২শ টাকার কিস্তি ছিল। সে টাকার চাপেই সে দিশে হারা। মামলা করার টাকা সে কোথায় পাবে। একেতো চিকিৎসা চালানোর টাকা নেই তারমধ্যে মামলা করলে আরও খরচ। রমজানের শুরুতে এ ঘটনার পর সংবাদ মাধ্যমের লোকজনকে ঘটনাস্থলে যেতে বাধা দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। জানা গেছে  শাহ আলমকে বাঁচাতে কাজ করছেন স্থানীয় এম পি বাবুর অনুসারী হিসেবে পরিচিত এলাকার প্রভাবশালী মহল। যাদের মধ্যে আছে, জনপ্রতিনিধিসহ রাজনৈতিক নেতাদের নাম। স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা জানিয়েছেন, ঘটনার ১৫ দিনেরও বেশী সময় পর ৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সভাপতি তপন শীলকে ডেকে নিয়ে বেত্রাঘাত করেছেন। অভিযোগ সে কেন মামলা করেনি! তিনি মঞ্জুর আলী প্রধান। যার ছোট ভাই চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী জাকির। নিজের স্ত্রীকে কুপিয়ে হত্যার দায়ে গ্রেফতার অছেন। মঞ্জুর নিজেও সুমনা হত্যা মামলার ৩ নং আসামী। তিনি আরও জানান শাহ আলমকে থানায় ধরে নেয়ার পর ১৫ হাজার টাকার বিনিময়ে সে ছাড়া পেয়েছে। এ সময় স্থানীয় কাউন্সিলর মোসলেম ও যুবলীগ নেতা তানভীর সঙ্গে ছিল। সাবেক ছাত্রদল ও বর্তমান যুবলীগ নেতা তানভীরের সম্পৃক্ততার অভিযোগ পেলে ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততার ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। জবাবে তিনি জানান, সজলা কিংবা শাহ আলম কারো সঙ্গেই তার ব্যক্তিগত কোন সম্পর্ক নেই। গোপালদী পুলিশ ফাড়ির ওসি আহসানের অনুরোধে তিনি ঘটনা কি ঘটেছে জানার জন্য সজলাদের বাড়িতে যান। সেখানে গিয়ে সজলার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন ঘটনায় শাহ আলমের কোন দোষ নেই। তার অসচেতনতা ফলে ভাতের হাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময় এমন ঘটনা ঘটেছে। শাহ আলম বরং মানবিকতার স্বার্থে প্রায় ৩০/৪০ হাজার টাকা খরচ করে চিকিৎসা করিয়েছে! আগামীতেও সে চিকিৎসা করাবে। থানায় তানভিরের উপস্থিতির কারন সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সজলা এবং শাহআলমের অনুরোধেই তিনি থানায় গিয়েছেন। মাড়হীন ভাত কেমন করে শাড়ীর ভেতরে প্রবেশ করে পিঠ পুড়লো এবং ঘটনায় জড়িত না থাকা সত্বেও শাহ আলম কেন চিকিৎসা করাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি তেমন কোন সদোত্তর দিতে পারেন নি। বরং বলেছেন এটা তারও প্রশ্ন। তানভীর এমপি বাবুর কাছের লোক হিসেবে পরিচিত। নির্মম নির্যাতনের শিকার সজলা শীল মাথা নীচু কন্ঠে পিঠে দগদগে ঘা আর চোখের কোনে জল নিয়ে বললেন, খুব ভাল আছি। এরপরে তিনি কথা বলতে অনীহা প্রকাশ করেন। গোপালদী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আহসান প্রথমে বলেছিলেন শাহ আলম নয় বরং সজলার স্বামীই সজলার গায়ে গরম ডাল ছুড়ে মেরেছিল। পরবর্তীতে তার বক্তব্য পাল্টে বলেছেন স্বামী নয়, বরং সজলার নিজের দোষেই তার শরীর পুড়েছে। সজলা ও তার স্বামীর বক্তব্য অনুযায়ী এঘটনায় শাহ আলমের কোন দোষ নেই। এ ব্যাপারে সজলার পরিবার কোন অভিযোগ করলে পুলিশ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হতো বলেও তিনি জানান। প্রকৃত ঘটনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, শাহ আলম সজলাকে লাত্থি দেয়নি। রান্না করার সময় চুলার পাশে থাকা বাঁশে শাহ আলম রাগ করে লাত্থি দিলে সজলা ভয় পেয়ে চুলায় পরে যায়! শাহ আলমের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে এমন অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন। প্রসঙ্গত, প্রথম রমজানের দিন গরম ডালের পানি দিয়ে তার শরীর ঝলসে দিয়েছেন তারই বাড়িওয়ালার ছেলে শাহ আলম। ঘটনার পর থেকেই এটি ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে গৃহবধূকে ঝলসানো ছবি বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে “ভাইরাল” হয়ে পড়াসহ দৈনিক যুগের চিন্তায় একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশে এলাকায় রীতিমতো তোলপাড় শুরু হয়। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশেও স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল বাধা সৃষ্টি করে আসছে। তবে কখনও গরম পানি কখনও গরম ডাল তার পিঠে ছোড়া হয়েছিল বলে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছিল শাহ আলমের অনুসারীরা। এদিকে অভিযোগ উঠেছে ভয়ে থানায় অভিযোগ দিতে পারেনি ঝলসানো গৃহবধুর স্বামী স্বজনরা। এমনকি তারা মুখও খুলতে ভয় পাচ্ছে।  আহত গৃহবধূ সজলা শীল স্থানীয় উলুকান্দির বেপারীপাড়া এলাকার স্বপন শীলের স্ত্রী। গোপালদী ফাঁিড়র ইনচার্জ আহসান, শাহআলম ও স্থানীয় নব্য আওয়ামী লীগের নেতা তানভীর এবং স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার সোলমান আড়াইহাজার থানা বসেই ওই ঝলসানো নারীর কাছ থেকে একটি লিখিত (সাফাই) স্বাক্ষী নিয়েছেন বলে একটি সূত্র জানায়। এতেই ঘটনাটি পুরোপুরি ধামাচাপা পড়ে যায়।
এই বিভাগের আরো খবর