শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ৭ ১৪৩১

দূষণ-দখলে বিপন্ন শীতলক্ষ্যা

প্রকাশিত: ১২ মে ২০১৯  

শামীমা রীতা (যুগের চিন্তা ২৪) : ‘এহন আর এনো (এখানে) মাছ পাই না গো মা, তয় মাঝে মাঝে লাশ উডে। এই ডরে গত এক বছর ধইরা নদীতে জালও ফালাই না। কুনসুম (কোন সময়) কি বিপদে পড়ি! হাসতে হাসতেই কথাগুলো বলছিলেন ষাটার্ধ্ব কার্তিক দাসের। 


দুই ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে শীতলক্ষ্যার পূর্বপাড়ে বন্দর উপজেলায় কার্তিক দাসের বসবাস। তিন পুরুষ ধরেই তাদের একমাত্র জীবিকার উৎস এই শীতলক্ষ্যা নদী।  কার্তিক দাস জানান, বাপ-দাদা গো দেখছি মাছ ধরতে। 


ওনাগো দেইখাই এই কাম ধরছিলাম অন্যকামে আর যাওয়া হয় নাই। তারগত ৪৫ বছর যাবৎ এই কামই করি। তয় এখন আর কাম করি ঘর চলে না। পোলারা বিয়া সাদি করি অন্যখানে ঘর বানছে। মাইয়া একখান ঘরে আবিয়াইস্তা (অবিবাহিত)। এ জন্য মধ্যে মধ্যে মাডি (মাটি) কাটার কামও লই।


কথা বলতে বলতে শীতলক্ষ্যায় কাটানো পঞ্চাশ বছরের আগে ফিরে যায় কার্তিক দাস। চোখ চোখ মুছতে কার্তিক বলেন, কত মাছ ধরছি কত ক্ষেপ লইয়া এ নদী পাড়ি দিছি হিসাব নাই। বর্ষাকাল আইলে আগে দুই কূল উপচাইয়া মাইনষের বাড়ি বাড়ি পানি উঠতো। 


আগে তো এত বড় বড় বিল্ডিং আছিলো না দুই পাশে ছিলো পাটের গুদাম আর ক্ষেত (ফসলী জমি)। এ ক্ষেতে ক্ষেতে পানি উইঠ্ঠা ডুইব্বা যাইতো। এহন আর কি আর আগের মত শীতলক্ষ্যা আগের মত আছে। এক সময় এ পানি বিদিশীরা লইয়া যাই তো। আমরা এ পানি দিয়া রান্নার কাম করতাম। ভিনদেশি ব্যবসায়ীরা ঘাটে নৌকা ভিড়াইয়া এ পানিতে রান্না-বান্নার কাজ গোসল সারতো। 


এহন তো এ পানি খাওয়া দূরে থাক গায়েও লাগান যায় না। চুলকানি উঠে। একই কথা মাছ ব্যবসায়ী রতিন বেপারী, মাঝি শরিফ হাজী,মর্শেদ মিয়াদের মুখেও। মাঝি মোর্শেদ মিয়া জানান, আগে নৌকা বাইলে বৈডা বাইলে বৈডার লগে মাছ ঠেকতো এহন ঠেকে পলিথিন,ময়লা,লাশ। বাতাসের লগে ভাসে দূর্গন্ধ ।
অথচ এই নদীর তীরকে ঘিরেই নারায়ণগঞ্জ বন্দর ও শহরের গড়ে ওঠা। এক সময় শীতলক্ষ্যা নদীর উভয় তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের এককালীন বিখ্যাত মসলিন শিল্প। এমনকি পৃথিবীর বৃহত্তম পাটকল ‘আদমজী জুট মিল’ও শীতলক্ষ্যার তীরে অবস্থিত ছিল। যা এখন শুধুই ইতিহাস, গল্প-উপন্যাসের পাতায় পাতায়। 


বর্তমানে দূর্গন্ধ আর কালো পানিই শীতলক্ষ্যা নদীর নিদর্শন। বর্ষার মৌসুমে কিছুটা প্রাণ ফিরে পেলেও বছরের বেশিরভাগ সময়ই একই অবস্থা থাকে। কল-কারখানার, গৃহস্থালী, মেডিকেল বর্জ্যেসহ নানান ধরণের বর্জ্যরে সমাগমস্থল এখন এ শীতলক্ষ্যা। 


জানা গেছে, ২০০৭ সালের অক্টোবরের মধ্যে প্রতিটি শিল্প-কারখানায় ইটিপি বা বর্জ্য পরিশোধন প্রকল্প বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু  প্রতিষ্ঠান মালিকদের মধ্যে তেমন কোনো সাড়া মেলেনি। পরে ২০১০ সালের জুনের মধ্যে তা বাস্তবায়নের  নির্দেশ দেওয়া হয়। 


যেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে তরল বর্জ্য শীতলক্ষ্যায় নিক্ষিপ্ত হয়ে থাকে, সেগুলো হচ্ছে ডাইং ফ্যাক্টরি, পাল্প অ্যান্ড পেপার মিল, কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, সুগার মিল, অয়েল রিফাইনিং, টারবাইন পরিচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র।


 নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ের দুই হাজারেরও বেশি শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে তরল বর্জ্যে নির্গমনকারী প্রতিষ্ঠান হল ৩৪৪টি। এর মধ্যে শিল্প-কারখানাগুলোতে বর্জ্য শোধনাগার (ইটিপি) রয়েছে ২৮৭টি প্রতিষ্ঠানের (২০১৮ এর তথ্য অনুযায়ী)। যার অধিকাংশরই কার্যক্রম নেই।


এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক সাঈদ আনোয়ার জানান, যেসব প্রতিষ্ঠান ইটিপি স্থাপন করেছে তাদের মধ্যে সবগুলো প্রতিষ্ঠান তা ব্যবহার করছে কি-না  তা খতিয়ে দেখা হবে। যেহেতেু আমি সদ্য নিযুক্ত হয়েছি সেক্ষেত্রে আমার এ সকল বিষয়ে অবগত হতে কিছুটা সময় লাগবে।  


শুধু তরল বর্জ্যে নয় গৃহস্থালীর বর্জ্য ও শহরের সিটি করপোরেশনের বর্জ্যরে  একটা বিরাট অংশ নদীতে গিয়ে পড়ছে। এসব কারণে নদী তীরবর্তী বাতাস ময়লা-আবর্জনায় দূষিত হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। নদীর পাড় ঘেঁষে ফেলা হচ্ছে পলিথিন ও অন্যান্য বর্জ্য। এসব বর্জ্য আসছে স্থানীয় মার্কেট ও আড়ৎ থেকে। 


১১ মে সরজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নদীর পানিতে রঙ ধরেছে। স্্েরাতের সাথে ভেসে চলেছে পলিথিন, ফলের খোসা, প্লাস্টিকের বস্তা,বোতল। কচুরিপানার চেয়ে ময়লার পরিমাণই বেশি। স্থানীয় বাসিন্দা চন্দ্র শেখর জানান, পাশেই থাকি। গত ২৫ বছর যাবৎ এ শীতলক্ষ্যার তীরেই বসবাস। 


চোখের সামনেই শীতলক্ষ্যাকে মরতে দেখছি। এক সময়ে খরস্্েরাতা নদীটি এখন অনেকটাই ম্লান। বর্ষায় কিছুটা পুরোনো ঢঙে এলেও দূর্গন্ধটা কমে না। দেখেন না কিছু একটা করতে পারেন কিনা।


বন্দর রুপসী এলাকার বাসিন্দা নিলুফার। এইচএসসি পরীক্ষার্থী । নিলুফার জানান, প্রতিদিনই যাই আসি যাই। আগে ভালো লাগতো। কিন্তু এখন কেমন যেন লাগে। কালোপানি তার ওপর দূর্গন্ধ। 


পাশে দাড়িয়ে থাকা এক কিশোর হাসতে হাসতে জানান, কেউ যদি আমার চোখবেঁধে দিয়ে এখানে নিয়ে আসে। গন্ধ শুকে বলে দিতে পারবো এটা শীতলক্ষ্যার পাড়।


এদিকে দূষণের সাথে দখলে  বিপন্নশীতলক্ষ্যা।  নদীর সীমানা পিলারের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে অনেক অবৈধ স্থাপনা। নদীর পাড় দখল করে প্রভাবশালী মহল বালির আড়ত, অটোরিকশা স্ট্যান্ড, ব্যবসায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে  রমরমা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। 


তবে ইতিমধ্যেই বিআইডব্লিইটিএ নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর এর উদ্যোগে শীতলক্ষ্যা তীরে কয়েক দফায় উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। সামনে এ ধরণের অভিযান আরো পরিচালনা করা হবে বলে জানান বিআইডব্লিউটিএ‘র নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দরের যুগ্ম -পরিচালক  মো.গুলজার আলী।
 

এই বিভাগের আরো খবর