বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪   বৈশাখ ১২ ১৪৩১

উত্তর দক্ষিণ

প্রকাশিত: ২৮ জুন ২০১৯  

পর্ব : চার

যখন আনোয়ারা থেকে বাসায় ফিরছি তখন গাড়িতে সবাই চুপ। সীমা সিটে হেলান দিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে। কিংবা চোখ বন্ধ করে আছে। পরিস্কার বোঝা যায় না সে কী করছে। এ সময়টা তাঁর কতটা অসহায় হতে পারে তা নিরূপণ করা সহজ নয়। আমি বার বার তাকাই বুঝতে চেষ্টা করি তাকে সাহস দেয়ার পথ খুঁজি।

 

স্বামী-স্ত্রীর বেশ কিছু বিষয়াদি থাকে, কথা থাকে তা অন্য কারোর সামনে প্রকাশ করা যায় না। এই কাজটি সময়ে যার যার মতো নিজেরাও করে থাকে কিন্তু যখন অন্যদের দেখে তখন তাদের কাছে বাড়াবাড়ি মনে হয়। বা হতে পারে তাদের কাছে ছ্যাবলামি পর্যায়ে। আমি সবার সামনে সীমাকে কিছু বলি না। ভাবতে থাকি পরে কি করা যায়। কোথায় নিয়ে যাওয়া যায়। কীভাবে এর চিকিৎসা করানো যায়। এ পৃথিবীতে কত ঘটনা ঘটে যার ব্যাখ্যা দেয়া অসম্ভব। সীমাকে বাঁচাতে হবে। তাঁকে এই পৃথিবীতে আরও লম্বা সময় থাকতে হবে।

 

আমাদের ভালোবাসার প্রথম পর্যায়ে আমরা অনেক ঘুরাঘুরি করেছি। একবার খালাতো বোন ডেইজী আপার বিয়ে চট্টগ্রামে। দাওয়াত আমাদের পুরো পরিবারের। কিন্তু এতদূরে কে যাবে। যাতায়াতের অনেক খরচ রয়েছে। কিন্তু আমি চলে গেলাম। একদম একা। বাস থেকে নেমে পথ খুঁজে পাই না। রাস্তায় হাঁটছি বিশ্বাস আছে আমি ঠিকই গন্তব্যে পৌঁছে যাবো। ঠিকানা বলতে জানতাম ইয়াকুব ম্যানশন, দেব পাহার লেন, চট্টগ্রাম কলেজের পাশে। আমি হাঁটছি সেদিকেই। এমন সময় রাস্তায় আমার ছোটো মামার সাথে দেখা তিনি রিক্সায় বাসায় ফিরছেন। মামা আমাকে দেখে বললেন- তুই একা চলে এসেছিস। তা আবার পরিষ্কার ঠিকানা ছাড়া !

 

তিনদিন পর সীমার সাথে আমার ঘুরতে যাওয়ার কথা কলেজ ফাঁকি দিয়ে। আগের দিন ফিরছি। সন্ধ্যায় লাভ লেইন বাস স্ট্যান্ডে এস দেখি বাস নেই। লাস্ট বাস ছেড়ে গেছে আরও আগে। তাহলে পরদিন সকালে কলেজ যাওয়ার পথে আমি তাকে নিয়ে বের হবো কীভাবে ? তখন ইন্টারনেট, মোবাইলের যুগ না। যে যখন তখন বলা যায়। ল্যান্ডফোনও থাকে বিশেষ কিছু পরিবারের দখলে। অবশ্য আমি কোনো টেনশন ফিল করছি না কারণ কেনো জানি আমি ঠিক সময়ে পৌঁছে যেতে পারবো এমন ধারণা পোষণ করছি। এ নিয়ে আমার বিন্দুমাত্র দুর্ভাবনা হচ্ছে না। কোনোরূপ সন্দেহ হচ্ছে না। 

 

ঢাকাগামী আমি এক লোডেড ট্রাকে চেপে বসলাম। ড্রাইভারকে বলে কয়ে খাওয়ায়ে বিষয়টি কতটা গুরুতর বোঝায়ে সোজা ছাদের উপর চড়ে বসলাম। ড্রাইভার ভাই এমন অনবদ্য প্রেমের গল্প শোনে তিনিও খুব উচ্ছসিত। তিনি বললেন-তুমি চিন্তা করো না ঠিক সময় মতো তোমাকে পৌঁছে দেবো। আমি ট্রাকের উপর সারারাত তেরপাল বাঁধা রশি শক্ত করে ধরে বসে রয়েছি। গাড়ি চলছে। মাথার উপর অসংখ্য তারা সাথে সাথে চলছে মিট মিট করে তারা জ্বলছে। জ্বলা বলা ভুল হয়তো তাদের জমানো প্রেমের নরম মধুর উত্তাপ ছড়াচ্ছে। কয়েকটি তারা মনে হলো আমার সাথে কথা বলতে চায়। ভালোবাসার রজ্জু বাঁধতে চায়। আমি বলি আমার ভালোবাসার মাটির মানুষের কাছে ছুটে চলেছি। কি দরকার তোমাদের। তোমরা থাকো মাথার উপর। শোভা হয়ে। ধরা যায় না ছোঁয়া যায় না। থাকো তোমরা দূরেই থাকো।

 

রাতে ট্রাকের ছাদে চড়ে এতটা লম্বা পথ পাড়ি দেয়া কি যে আনন্দের ছিলো তা বলে শেষ করা যাবে না। কখন যে পথ ফুরিয়ে গেলো ঠিক বোঝা গেলো না। রাতের পথ পাড়ি দেয়া ট্রাকের খোলা ছাদে তা অপূর্ব অনুভূতি। হালকা মিঠে কিন্তু প্রবল বেগে বয়ে যায় বাতাস। গাড়ির গতির সাথে যা জড়িয়ে আছে। কখনও কোনো বাঁকে নদী আসে, কখনও দূর কোনো অচেনা গ্রাম কাছে এসে আবার দূরে চলে যায় অন্যরকম এক ভালোবাসা জাগিয়ে। 

 

নদীর উপর টিম টিম করে জ্বলা কোনো জেলে নৌকায় বাতির যে টান তা প্রেয়সীর টানের মতই আমাকে টানে। যেতে বলে। কোনো টিনের ঘরে বা মাটির ঘরে পিদিমের আলোয় কোনো কিছু ভাসে না। দেখি সে আলো জোনাকির মতো দূরে জ্বলে আর নিবে। আমার ভিতর সে অস্পষ্ট আলো কেমন যেনো উদাস করে তোলে। অন্যরকম এক জাগতিক চিন্তায় উচাটন মস্তিষ্ক এক ঘোরের মাঝে প্রবেশ করে। আমি তখন আরও শক্ত করে তেরপালের উপর রশি ধরে থাকি। যেনো অন্যমনস্কতায় পড়ে না যাই।

 

ড্রাইভার যিনি তিনি ছিলেন ভীষণ রসিক। পথে দাউদকান্দি ও মেঘনা এই দুটি ফেরি পার হওয়ার সময় তিনি আমাকে আপ্যায়ন করেছিলেন নিজের টাকায়। ঠিক সাড়ে ছ’টায় আমি পৌঁছে গেলাম চিটাগাং রোড। মধ্য বয়স্ক পিতৃসম ড্রাইভারটির নিকট যখন বিদায় নিচ্ছি তিনি তখন বেশ গর্বিতবোধ করছিলেন। তাঁর স্নেহ মাখা সেই হাসি আমি কোনোদিন ভুলবো না। তিনি আমার পকেটে বিশটি টাকা গুজে দিয়ে বললেন-আবার দেখা হবে। আমি অবাক তাকিয়ে রইলাম তাঁর যাওয়ার পথে। তবে এ জীবনে আমি বহু এমন ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি যা অনেকের কাছে বিস্ময়ের।

 

যখন আমি মিশনপাড়ায় এসে পৌঁছলাম ঠিক তখন ঘড়িতে সাড়ে সাতটা। সীমা তাঁর আইন কলেজের বাসা থেকে বের হলো। কাটায় কাটায় সময় মিল রেখে দুজন দুদিক থেকে এসে কেমন করে মিলে গেলাম! আমার এখনও মনে আছে সাদা সেলোয়ার কামিজ। সাদা ভাঁজ করা ওড়না কাঁধে ও পেটে বেল্টে আটকানো। সাদা ফিতা দিয়ে ফুল করে দুই বেনী গাঁথা মাথার চুল। চোখে গাঢ় কাজলের টান। যা আমার খুব পছন্দ। তখন অনেকটা তাঁর পাতলা শরীর। বুকের মাঝে ক্লাসের বই চেপে ধরে চাষাড়ার দিকে হাটছে, চোখদুটু শুধু রাস্তায় নিবদ্ধ। এছাড়া ডানে বায়ে কোনো দিকে খেয়াল নেই। কখন যে আমি পাশে এসে তার সাথে পায়ে পায়ে হেঁটে চলেছি কোনো খেয়াল নেই। যখন আমি ডাকলাম তখন গভীর বিশ্বাসের সাথে আমার দিকে তাকায়, সামান্য হাসে। ও যেনো জানতো আমি কোনো ভাবেই মিস করবো না। আমি যেখানেই থাকি ঠিক সময় মতো হাজির হয়ে যাবো। ও জানতো জান বাজি রেখে আমি কথা রাখতে জানি।

 

বড় কঠিন সংগ্রামের মধ্যে আমার জীবন পার হয়েছে। কোথাও ব্যর্থতা আমার সহ্য হয় না। আমি মানতে পারি না। আমার ভীষণ কষ্ট হয়। প্রচ- জেদ চাপে। সাড়ে সাত বছরের ব্যর্থতার সার্টিফিকেট আর দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আমি দেশে আসি দুবাই থেকে। সেখানে প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি। এই অবস্থায়ও অনেকে আসতে চায় না। একদিকে আধুনিক শহরের ঝলমলে চাকচিক্য আর দেশের অভাব-অনটনের কথা ভেবে দুবাই পড়ে থাকে অনেকে বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ। আমি এমনি সাদামাটা জীবন চাই নি। মাসের অর্ধেকটা সময় কেনো শুয়ে বসে কাটবে?  আমি ব্যস্ত থাকতে চেয়েছি সারাক্ষণ।

 

আমার অনেক বড় স্বপ্ন ছিলো। যা অনেকের থাকে না তা আমার ছিলো, আছে সে হলো মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা। সর্বত্র আমার চারিদিকে রয়েছেন তাঁরা যারা আমাকে ভালোবাসেন। আমি যেখানে যাই সেখানেই ভালোবাসার মানুষ খুঁজে পাই, খুব অল্প সময়ের মধ্যে। এর কারণ হলো পবিত্রতা যেখানে থাকে সেখানে দ্রুত গভীর টান তৈরি হয়। আমি সবার কাছে আমি আমার স্বপ্নের কথা বলি। তাঁরা অনেকেই তখন তার মধ্যে আমার স্বপ্ন দেখা শুরু করে। আমার স্বপ্নগুলোও সার্বজনিন। ব্যক্তি কেন্দ্রিক নয়। যদিও নানা টানা-হ্যাঁচড়ায় আমার সেই স্বপ্ন ধূসর হয়ে এলেও এখনও দেখা ভুলে যাই নি। কিন্তু এত দৌড়াদৌড়ি, এত পরিশ্রমের পর যখন কোনো কুল-কিনারা পেতাম না তখন এই জীবন বিষময় মনে হয়। সেই দুঃসহ সময় পাস করার জন্য আমি কোনো আড্ডা বা অন্য কোনো কিছুতে মেতে থাকা আমার সহ্য হয় না। তবে এই নষ্ট জীবন আমার খুব ভারী মনে হয়। বিস্বাদ লাগে সব কিছু।

 

অনেকের বিশ্বাসযোগ্য হবে না। বাঁচতে কিন্তু আমি চাই নি। দিন রাত শুধু অভাব-অনটন সাথে সীমাহীন দুশ্চিন্তা। বছরের পর বছর, যুগ চলে যায়। চুল পড়ে, সফেদ হয়, দাঁত নড়ে, ব্যথা ওঠে অতপর অবশ করে ফেলতে হয়। দাঁত কেনো শরীরের কোনো প্রকার যতœ নেয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না। এটা এমন এক ব্যবসা। এই যে দর্জি ব্যবসা যা আমি করি এর মতো জঘন্য ব্যবসা আমার আর জানা নেই। এটা কোনো প্রকার ভদ্রলোকের ব্যবসা হতে পারে না। ১৯৮৬ সন থেকে আমি জানি। এর প্রতিটি পরতে পরতে কী বিষ সে আমার ভালো জানা হয়ে গেছে। দূর থেকে কেউ বুঝবে না। 

 

দর্জিদের একাডেমিক কোনো শিক্ষা থাকে না। থাকে না কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ। ওদের নিয়ে যারা ব্যবসা করতে পেরেছেন। তাদের কৌশল ভিন্ন। যে কোনোভাবে তাদের আটকায়ে ফেলতে হয়। আমি এর নানা রকম কৌশল দেখেছি। কোথাও ভবিষ্যতের লোভ দিয়ে টাকা মাসে মাসে কিছু পরিমাণ আটকায়ে রাখা। নানাভাবে সুযোগ-সুবিধা দেয়ার কথা বলে তাদের টাকা নিজেদের কাছে জমা রেখে পরে অতিরিক্ত কাজ আদায় করে নেয়া। তার উপর থাকে একটি শক্ত ম্যানেজম্যান্ট। একটু টেরবেটের হলে কড়া শাস্তি। যা দেখে বাকিরা ভয় পায়। ভয় আর স্বপ্ন দেখানো ছাড়া এখানে সহজে কাজ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অতিরিক্ত বেতন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে অতিরিক্ত কাজই আদায় করে নেয় বড় বড় কোম্পানিগুলো। এদের ভয় হলো চাকুরি হারাবার ভয়। কারণ ততদিনে তাদের বড় মাপের বেতনে সংসার, সংসারের সদস্যরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। সে জ্বালা শুধু ভূক্তভোগীরা জানেন। কিংবা জ্বালা-যন্ত্রণার উর্দ্ধে ওঠে তারা এক প্রকার রোবোটিক জীবন-যাপন করেন।

 

তার উপর এ যেন স্পার্টাকাসের সময়। বেশির ভাগ কৃতদাসকে ভয় দেখানোর জন্য একজন বাছাই করে তার উপর সজোরে বর্শা নিক্ষেপ, কিছু বোঝার আগে হঠাৎ মৃত্যু। এমন নিষ্ঠুরতা আমার দ্বারা হয় না। আমি ভালোবাসার প্রশস্ত বুক মেলে ধরি। তাদের সাথে একসাথে বসে খাই। একই রকম পাত্র সবার জন্য ব্যবহার হয়। মনে মনে পরম নির্ভরতার সাথে বলি ভালোবাসায় সব জয় করা যায়। না, আমার ধারণা এখানে সম্পূর্ণ ভুল।

 

ভালোবাসারও কৌশল থাকে। প্যাঁচানো কৌশল। যেনো তারও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। কৌশলীরা ভালোবাসা টিকিয়ে রাখে বহুকাল। যেমন অন্যায় দেখেও তারা মুখ ঘুরিয়ে রাখে। কোনোরূপ প্রতিবাদ করে না। চিন্তা করে লাভ কী সে তার মতো চলুক। শান্তি বজায় থাকুক। তারা হিসেব-নিকেষেও পাকা। যা যাবে তার নিজের ঘাটের বা নির্দিষ্ট বরাদ্দের যাবে। যাক, তাতে কিছু যায় আসে না। মূল সব কিছু থেকে কৌশলে তাদের দূরে রাখতে তারা খুব ভালো জানে। যা করুক তার বরাদ্দের উপর থেকেই করুক। গোপন কিন্তু শক্ত সিস্টেম। আমি জানতাম না। আমিতো বোকা। বোকার স্বর্গে আছি। না হয় চিরদিনের প্রথায় পরিবর্তন আনতে যাবো কেনো ? কেনো চিন্তা করি সমবন্টনের ?

 

গাড়ি পৌঁছে যায় মোল্লা ভবন। রাতে সীমা ভাত খেতে পারে না। একগ্লাস মজো খেয়ে শুয়ে পড়ে। আমি আমার কাজ শেষে শুয়ে পড়ি। আজ একটু আগে আগে শুয়ে পড়লাম। ঘুম আসে না মাথায় এলোমেলো চিন্তা। মৃত্যুর ভয়। প্রিয়জনের মৃত্যু সে ভাবা যায় না। নিজের মৃত্যু নিয়ে অভিমানে কত রকমভাবে ভাবা যায়। কিন্তু প্রিয়জনের মৃত্যু, সে ভাবা যায় কী ? ঘর অন্ধকার। বাহিরের জানালা দিয়ে কিছু আলো আসে। তাতে কোনো কিছু স্পষ্ট নয়। ঘরে অন্য আরেকজনের উপস্থিতি বোঝা যায় না। আমি বিছানা থেকে নেমে যাই। অন্ধকারে পয়চারী করি। চিন্তা করি হঠাৎ এই ধাক্কা আমাকে, সামিরকে, গোটা পরিবারকে কোথায় নিয়ে যাবে ? কপর্দকহীন, ঋণগ্রস্ত একজন মানুষ আমি। তার উপর এ কথা কেউ বিশ্বাস করে না। যা আরও কষ্টকর। আমি যে বহু দেনায় জর্জরিত। না, একটা স্বার্থন্বেষী মহল তারা বলে বেড়ায় আমি মস্তবড় ধনী, আমাকে তারা এভাবে একটা ট্র্যাপের মধ্যে ফেলে।

 


অন্যদিকে সার্মথ্যবানদের এক ধরনের চালাকি। উড়িয়ে দেয় আমার দুঃখ, কষ্ট। বরঞ্চ আরও কষ্ট বাড়িয়ে দিতে তারা মস্কারা করে। আরে কী বলো- তোমার কী এমন হতে পারে ? আমরা কি তোমারটা চাইবো? আসলে নিজেকে সেফ করার চমৎকার কৌশল! অপেক্ষাকৃত ধনীরা যারা নীচের দিকে আছে তাদের সাথে যে ঠাট্টা-মস্কারা করে তা বড় বেদনার, বড় মর্মান্তিক।

 

যাক সে সব কথা। বর্তমানে আমার এখন একটাই চিন্তা-সবাইকে নিয়ে যতটুকু সম্ভব সীমাকে আনন্দের মাঝে রাখা। চিকিৎসার শেষ পর্যন্ত দেখা। টাকা জোগার করা।

 

রাত পার হতে চায় না। হঠাৎ মনে হলো সীমার পাসপোর্টটি দেখার। দেখলাম মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে বহুবছর। স্থির করলাম সকালে প্রথমে পাসপোর্ট জমা দিয়ে দেবো। কয়েক মাস পূর্বে জিনা, সীমার দুজনের আমি পাসপোর্ট ফরম ফিলাপ করে রেখেছিলাম। সময় করে আর জমা দেয়া হয় নি। পরদিন সকালেই সব ব্যবস্থা করে ছোটলাম পাসপোর্ট অফিস। ওখানকার ব্যবস্থাপকের রুমে গিয়ে জরুরি বিষয়টি জানালাম। তিনি নিজে ব্যবস্থা নিয়ে সাতদিনের মধ্যে পাসপোর্ট হাতে দিবেন বলে কথা দিলেন।

 

এরই মধ্যে বেশির ভাগ রিপোর্ট হাতে চলে এসেছে। কোথাও ভালো কোনো সংবাদ নেই। তখন এইসব তেমন বুঝি না। চিকিৎসকগণ যা বলেন তা মন দিয়ে শুনি আর আঁৎকে ওঠি।

 

রিপোর্টগুলো নিয়ে সমবায় মার্কেটে গেলাম। ছোট বোন হেনার ছেলে তনয়ের দোকানে গিয়ে ওর হাতে বোঝায়ে দিয়ে এলাম স্ক্যান করার জন্য। কী যে এক অস্থিরতা কাজ করছে, কোথাও গিয়ে শান্তি পাই না।

 

স্ক্যান করার পিছনে একটি কারণ আছে। আমার বাল্য বন্ধু শাহাব ডাক্তার। থাকে আমেরিকায়। ওখানে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ওর যথেষ্ট সুনাম। মানুষ হিসেবে যাঁর তুলনা আমি অন্য কারোর সাথে কখনও করি না। ওর তুলনা ওকে ছাড়া অন্য কেউ হতে পারে না। ওদের গোটা পরিবারই এমন। সবাই যাঁর যাঁর ক্ষেত্রে স্বনামে ধন্য। তাঁর নিকট রিপোর্টগুলো পাঠাবো। স্ক্যান করা ছাড়া মোবাইলে ক্লিক করে রিপোর্ট ভালো করে কিংবা সহজভাবে পড়া যায় না।

 

এদিকে যতটা সময় পারি সীমার সাথে সাথে থাকি। নানা দিকে থেকে বিভিন্ন মানুষজন আসছে তাদের সীমার ঘরে ঢোকার পূর্বে যতটুকু সম্ভব বুঝিয়ে শুনিয়ে দেই, যেনো এমন কোনো কথা বা দৃশ্যের অবতারণা না করে সীমা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। এত সাবধনাতার মাঝেও দু-একজন বেঁফাস কথা বলে ফেলে। কিংবা আবেগ ধরে রাখতে পারে না। এর মধ্যে আমার বড় বোন শাহীন ড্রাই ফুডসহ বেশ কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে দিয়ে যায়। যা শাহীন সবার বেলায় বরাবর করে থাকে।

 

রিপোর্টের স্ক্যান কপি পেনড্রাইভে পেয়ে গেলাম বিকালের মধ্যে। তনয় এসে দিয়ে গেলো। দেরি হওয়ার পিছনে কারণ হলো কিছু রিপোর্টের পেপার বড় হওয়াতে দুই তিন বারে স্ক্যান করে পরে ফটোশপে এডিট করতে হয়েছে।

 

আমি কোথাও গিয়ে শান্তি পাই না। আমার কোনো কাজে মন বসে না। মানুষের ঋণের কথা ভুলে যাই। বাড়ি ভাড়ার কথা ভুলে যাই। পাওনাদারদের এখন আর ভয় পাই না। ভাবি তারাওতো মানুষ। শুধু ভয় ব্যাংকের কিস্তির কথা ভেবে। এইসব প্রতিষ্ঠান কোনো কিছু দেখে না। মছলন্দপুরে কাজ চলছে সেখানে একজন বাটপার ওয়েল্ডার আছে তাকে নিয়ে কিছুট শঙ্কা থাকে। চোখের সামনে চোর বাটপার সব চালাতে পারি। চোখের আড়ালে কী করে বসে কে জানে, তার দুশ্চিন্তা হয়।

 

ওইদিন ভোর রাতে কম্পিউটার অন করে বসে আছি। আর সময় দেখছি। ঘড়ির কাটায় কাটায় ছ’টায় মেইল পাঠালাম শাহাবকে সীমার রিপোর্টগুলো সংযুক্ত করে। আর লিখলাম- আমি সব হারাচ্ছি। দেখ কী করা যায়।


কয়েক মিনিটের মধ্যে সুদূর আমেরিকা থেকে ফোন এলো। প্রথম কথা জামাল, তুই চিন্তা করিস না। আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। মাত্র বিশ মিনিটের মধ্যে ব্যবস্থা হয়ে গেলো বাংলাদেশের সেরা সেরা বেশ কয়েকজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পেয়ে গেলাম এপয়েন্টম্যান্ট। তখন বাজে সাত’টা। তবে সারে আটটার মধ্যে পৌঁছতে হবে মহাখালী জাতীয় ক্যান্সার ইনিস্টিটিউট গবেষণা ও হাসপাতালে। কাজটি সহজ নয়। নিজের গাড়ি নেই। শাহীনের ছেলে ভাগিনা লিওকে বললাম- তোমার গাড়ি ফ্রি আছে ? ও বললো- ড্রাইভার নেই, মামা। আমি বললাম তুমি স্ট্যান্ডে যাও একটি গাড়ি ভাড়া করো। দেখো, এসি যেনো ভালো কাজ করে। জুনের গরম তখন অসহ্য।

 

লিও ছুটলো নতুন কোর্টের ওদিকে গাড়ির স্ট্যান্ডে। সীমা তখন ঘুমাচ্ছে। আমি ওকে ডেকে তুললাম। বললাম তাড়াতাড়ি রেডি হও। ঢাকায় ডাক্তার দেখাতে যাবো। শাহাব ঠিক করে দিয়েছে। সীমা শাহাবের কতা শুনে বেশ উৎফুল্ল হয়ে ওঠলো। সীমা জানে শাহাব আমাদের জন্য কতটুকু করতে পারে।

 

লিওকে ফোন দিলাম-সে তখনও স্ট্যান্ডে পৌঁছতে পারে নি। আমি বললাম তুমি গাড়ি ঠিক করে চলে আসতে থাকো। আমি সীমাকে নিয়ে রিক্সায় এগোচ্ছি। ফোনে যোগযোগ হতে থাকবে। আমাদের দেখা হলো রাইফেল ক্লাবের কোনাটায়, যেখানে ট্রাফিক দাঁড়ায়।। লিও একটি ভালো গাড়ি ম্যানেজ করে দিয়েছে। ড্রাইভারটিও ছিলো বেশ ভদ্র। আমাকে বার বার বলেছেন- আপনি আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন দেখবেন ঠিক সময় মতো পৌঁছে যাবো।

 

অপরিচিত জায়গা। এর আগে আমি এ পথে আসা যাওয়া করেছি দু-একবার। কোনো কিছু ওই ভাবে খেয়াল করে নয়। ছোটো ভাই ময়েন ফোনে আমাকে বলে যাচ্ছে- ওই যে তিতুমীর কলেজ, পার হন। তারপর টিভি গেট তার ভিতরে চলে যান। ওখানে দেখেন জাতীয় ক্যান্সার ইনিস্টিটিউট গবেষণা ও হাসপাতাল। সেখানে ডিরেক্টরের রুমে চলে যাবেন।

 

প্রফেসর ডাক্তার মোয়ারফ হোসেন তিনি একজন লেডি ডাক্তার সহকারে সীমাকে দেখলেন। আমি বুঝলাম তাদের নিম্ন স্বরে ইংরেজিতে আলোচনায় অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। তাঁরা আমাকে ডাকলেন, বললেন- বুঝতেই পারছেন সব। তারপরেও আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করবো।

 

ঘন্টাখানেকের মধ্যে ৮১০ নম্বর শীততাপ নিয়ন্ত্রিত ভি আই পি কেবিন পেয়ে গেলাম। সেদিন ভাগ্য খুব ভালো ছিলো, এই কেবিন সাধারণত খালি থাকে না। এর মধ্যে বহু ডাক্তার এসে দেখে গেলেন। আমি দেখি সীমার মধ্যে আশার সঞ্চার হচ্ছে। যা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার প্রেরণা জোগায়। (চলবে...)

 

এটিএম জামাল
সোনারগাঁ ভবন, মিশনপাড়া, নারায়ণগঞ্জ
২৬ জুন, ২০১৯

এই বিভাগের আরো খবর